জীবনের দ্বৈততা, অর্জন ও পরাজয়, এবং পুরাণের কুৎসা ও মৃত্যুর পরবর্তী অবস্থার প্রতি এক দৃঢ় উপলব্ধি নিয়ে কবি জানাচ্ছেন- কিছুই পরিপূর্ণ নয়, এবং জীবনে অর্জন এবং ক্ষতি একসাথে চলতে থাকে। শুদ্ধতা বা পরিপূর্ণতা অর্জন করা সম্ভব নয়, এমনকি মৃত্যুর পরেও মানুষের অস্তিত্বের কিছু না কিছু বিরূপ দিক থাকে।
কাব্যগ্রন্থ : নরক গুলজারে বাজছে মেহেদী হাসান
কবি : তানহিম আহমেদ
রিভিউয়ার : সোহেল ইয়াসিন
🔹
কবিতা কি একরৈখিকভাবে বিশ্লেষণযোগ্য নাকি অনুভবের আকরে ধারণ করে নেয়া বৈচিত্র্য ব্যাখ্যার দাবি রাখা এক মহান শিল্প?
আপেক্ষিকভাবে কবিচিন্তার সমান্তরাল ধরে এগোবার প্রয়াস নিয়ে কবিতা পাঠ শুরু হলেও পাঠকমাত্রই শব্দ এবং ভাবগতির সাথে সাথে নিজেকে সম্পৃক্ত করে নেয় অজান্তেই।
যে অন্তর্দহন কিংবা উচ্ছ্বসিত শিহরণব্যাপ্তি কাব্যের লাইনে লাইনে এবং স্তবকে কবি বিছিয়ে দিয়ে যান তার অনুপ্রাস অবয়ব আমাদের বিবিধ কলেরবে দীর্ঘশ্বাস অথবা বিশাল আলোর মুখে দাঁড় করিয়ে দিতে চায়।
তানহিম আহমেদ নয়া প্রজন্মের কবি।
তরুন এই কবির 'নরক গুলজারে বাজছে মেহেদী হাসান' নিয়ে বসেছি।
শুরুর পৃষ্ঠায় কবির সরল স্বীকারোক্তির পর লিপিবদ্ধ কবিতাগুলো পড়তে গিয়ে দেখেছি, একটা শক্তপোক্ত স্থান অধিকারের আওয়াজ নেয়া কাব্যজ্ঞান নিয়ে তানহিম নিজের বিনয়কে ঝালিয়ে নিয়েছেন বৈকি।
◽
একটা রুগ্ন কুকুর
রাস্তায় পড়ে
থাকতে দেখে তোমাদের শর্টটার্মে যট্টুক
টনক নড়ে ওঠে-
আমার কবিতার দৌড় বড়জোর অইটুকুনিই বলতে পারো!
🔹🔹🔹🔹🔹
চলুন তাঁর বই থেকে কয়েকটি কবিতা পড়ি:
◽
আমরা তিন
১.
নরক থেকে মাঝেমধ্যে চিঠিপত্র আসে
দূরসম্পর্কের আত্মীয়ের পাওনার তাগিদ ভেবে খুলি না
ধুলো ধুলো মেঘ জমে ওঠে ক্ষীণ গজলের সুরে
ত্রস্ত ফাগুনে জ্বলে যায় রাঙতামোড়া খাম...
ছেঁড়া প্যারাশ্যুটও নামতে নামতে পায়
মাতৃগর্ভে পুনর্বার ফেরার স্বাদ
কিন্তু, আমাদের কোনো গর্ভকালীন স্মৃতি নাই
যৌথ ঘৃণায় তোমারামার তবু বেঁচে থাকা বহু বহু দিন।
চাঁদের আলোটাও শহুরে ব্যালকনিতে হয়ে গেছে জাল
কালোবাজারে চওড়া দামে গ্যাছে বিকিয়ে;
বিষণ্ণ দিনে- অতএব,
দুঃখ-কান্না জমাও রাশি রাশি...
ক'জনই বা জানে ঝড়ো হাওয়া মূলত বাতাসের দীর্ঘশ্বাস?
◽
২.
তুমিও যাচ্ছো চলে- মেট্রোর গতিতে
পিতাপুত্রের অংকের মতো সরলতর হচ্ছো
বয়েসের সাথে সাথে
তোমার পারফিউমের কৌটায় বাড়ন্ত গোলাপের সুঘ্রাণ
সবুজ শাসিত তল্লাটের টিয়াঠুটি আমেদের
তরঙ্গের মতোই মলিন;
সমস্তকিছু উপেক্ষা করে তুমি যাচ্ছো চলে, বৃষ্টিলীন।
তোমার যাওয়ার স্তুতি করবে গল্পগাছা কবির দল
উপমান ও উপমেয়ে
তুমি বনে যাবে ঘাসফড়িঙের স্যাঙর...
নারী নয়,
পৃথিবীরে তখন মনে হবে পুরুষ নদীর পরের পাটক্ষেত
শে যখন-
তোমার প্রস্থানের ক্লিশে
জীবনানন্দীয় উপমায়- মুহুর্মুহু বোমায় ছারখার...
🔹🔹🔹🔹🔹
এই তরুন কবির মগজে জুলাইয়ের টগবগে আলো এসে ভীড় করে। অকপটে নিজেকে প্রকাশ করে যান 'রিফিউজাল' কবিতায়-
◽
রিফিউজাল
(জুলাই ইন্টারনেট ব্ল্যাক-আউটের সময় লেখা)
তুমি সংকটকালের নিউজপেপার শিরোনামের মতোই অগভীর-
তোমার সঙ্গে আমি বন্ধুতা করবো না।
তোমার হাতে সন্তানের রক্তের ছাপ
স্পষ্টতর হয়ে উঠেছে
লেডি ম্যাকবেথ
তোমার সঙ্গে আমি বন্ধুতা করবো না।
ধৃতরাষ্ট্রের উত্তরসূরীরা অগ্রসর হচ্ছে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র নিয়ে
স্বজনের রক্তে তারা মাতবে হোলিউৎসবে
সাঁজোয়া বাহিনীর কর্ডনে তুমি আত্মগোপন করেছো
তোমার সঙ্গে আমি বন্ধুতা করবো না।
তুমি গণরোষের সম্মুখে কাঁপছো থরথর
আমার পা আঁকড়ে ধরেছে ৫৬ হাজার বর্গমাইলের ঋণ
তোমার সঙ্গে আমি বন্ধুতা করবো না।
প্রতিশোধপরায়ণ হাওয়া আমাকে আটকে দিচ্ছে
গণভবনের সিংহ দরোজায়
তুমি সম্ভব হলে নিরস্ত্র, দর্পমুক্ত মানুষী হয়ে এসো
শহিদের রক্তভেজা ঘাসের ওপর বসে ফুলমতী, ঋতুমতী বৃক্ষতলে
একটি দাবি...
একটিমাত্র সরল দাবি নিয়েই আলোচনা
হতে পারে, "কবে তুমি ছাড়ছো গদির জবরদখল?"
🔹🔹🔹🔹🔹
কবির মস্তিষ্কের কান্না এই জনপদ ছেড়ে গাজার জলপাইবনের মৃত পাতাদের সাথে উড়ে ঈশ্বরকে নালিশ জানায়। ক্লেদ এবং আক্ষেপ নিয়ে লিখেছেন-
" নদীবিধৌত স্বপ্নের দেশে
'মানুষ' জিতে গেলে যে জিতে যান ঈশ্বর
এইটেওতো তুমি জানতা না কিছুক্ষণ আগে অব্দি!
জানতা নেতানিয়াহুর আঙুলের ফাঁকে
মৃত জলপাইবন আছে;
আছে তিলোককামোদের মতো আব্রুহীন
অলিভ-অয়েলের খনি......."
🔹🔹🔹🔹🔹
বইয়ের শেষ কবিতা-
◽
পয়স্তী
যে পায় সে কি সবটা পায়?
যে হারায় সে-ও পায় কিছু না কিছু
ভাঙনে সব খোয়ানো শিকস্তির মতো সে-ও
পায় শোকের ডালি, করুণার তোড়া...
সুতরাং, তাত্ত্বিকভাবে সে-ও কিছুটা উইন-উইনে থাকে
সে-ও কিছুটা হয় পয়স্তী।
আবার যে পায় সে-ও কিন্তু কিছু হারায়
জিতে গিয়েও বিজিত সৈনিকের মতো থাকে না
লিড-নিউজে কোনো ডানপক্ষের সঙ্গে বামপক্ষের গোঁজামিল মেলাতে
গিয়ে খুঁজে পায় বেমিল, একটা গোল্লা...
সুতরাং, তাত্ত্বিকভাবে সে-ও কিছুটা পরাজিতই থাকে
সে-ও কিছুটা হয় শিকস্তি।
এতহি
বোঝা গেলো
হান্ড্রেড পারসেন্ট শুদ্ধ হয় না কিছুই!
এমনকি মৃত্যুর পরও মানুষ বেঁচে থাকে অন্যের কুৎসায়
নরক-গুলজারে...
পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়া পাণ্ডুলিপির মতো...
🔹🔹🔹🔹🔹
জীবন, পরাজয়, এবং অর্জন নিয়ে কবির কী এক গভীর দর্শন! জীবন ও মৃত্যুর গতি এবং তার পরিণতি নিয়ে কবি জানাতে চান- সবকিছুই আপেক্ষিক, এবং পূর্ণতা বা অপূর্ণতা আসলে একসাথে চলে আসে।
জীবনের দ্বৈততা, অর্জন ও পরাজয়, এবং পুরাণের কুৎসা ও মৃত্যুর পরবর্তী অবস্থার প্রতি এক দৃঢ় উপলব্ধি নিয়ে কবি জানাচ্ছেন- কিছুই পরিপূর্ণ নয়, এবং জীবনে অর্জন এবং ক্ষতি একসাথে চলতে থাকে। শুদ্ধতা বা পরিপূর্ণতা অর্জন করা সম্ভব নয়, এমনকি মৃত্যুর পরেও মানুষের অস্তিত্বের কিছু না কিছু বিরূপ দিক থাকে।
জীবন হল একটি প্রতিক্রিয়া, যেখানে প্রাপ্তি এবং হারানো, জয় ও পরাজয় একে অপরকে ধারণ করে চলে।
🔹🔹🔹🔹🔹
কবি তানহিম আহমেদ'র শব্দশিল্প আমাদের ক্রমশ মুগ্ধতার আলোতে এনে বাংলা কবিতার সমৃদ্ধ যাত্রাকে আরো অধিক আনন্দময় করবে বলে আমার বিশ্বাস।
Social Plugin