কবিতা লেখা আমার কাছে এবাদতসম
- ইমন ভাদ্রে
সাক্ষাৎকারটি প্রকাশিত হয়েছিলো বর্ণমালার নববর্ষ সংখ্যা ২০২২ - এ। তিন বছর পর সাক্ষাৎকারটি বর্ণমালার নতুন সংস্করণে পুনঃপ্রকাশিত হলো।
অবিনাশী পদ্যের কবি ‘ইমন ভাদ্রে’।
নিজের প্রথম প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ ‘অবিনাশী পদ্য’-র মাধ্যমে পাঠকমহলে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন। কবিতা নিয়ে কবির দর্শন ও তার জীবনবোধ নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা হল বর্ণমালার সাথে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন দেওয়ান রহমান।
দেওয়ান : কেমন আছেন?
ইমন ভাদ্রে : সব মিলিয়েই আছি। চলেছে জীবন, জীবনের ধর্ম জীবনের নিয়মে।
দেওয়ান : কবিতা আসলে কী? আমরা কীভাবে বুঝবো কোনো লেখা কবিতা হয়ে উঠেছে?
ইমন ভাদ্রে : কবিতা কে ধরা বাঁধা সংজ্ঞায় যারা সংজ্ঞায়িত করে করুক আমি করতে চাই না। মনের অব্যক্ত ভাব কে অর্থপূর্ণ করে প্রকাশ করবার নাম ই আসলে কবিতা। তবে সত্যিকার অর্থে একটি মানসম্মত কবিতা তখনই হয়ে ওঠে, যখন এর মধ্যে সুন্দর কোন বক্তব্য থাকে। এবং সেই বক্তব্য বা কবিতাটির মূলভাব কে পাঠক গবেষণা করে বের করবে। পাঠক কে যদি কবিতাটি জ্ঞান অন্বেষণের জন্য ভাবনার সায়েব নিমজ্জিত না করে, পড়া মাত্রই যদি বুঝে ফেলতে পারে তবে সে কবিতা গুণগত মানের কবিতা নয়।
দেওয়ান : আপনার কবিতার জগতে আসার গল্পটা কী? কখন, কীভাবে আপনার ও কবিতার মাঝে একটি সেতুবন্ধন খুঁজে পান?
ইমন ভাদ্রে : এ বিষয়ে বিস্তারিত বলতে চাচ্ছি না, তাহার তিরোভাবে আমার কবি জন্মের আবির্ভাব। আশা করি যা বুঝবার তা বুঝে নিয়েছেন। কবি ও কবিতার সেতুবন্ধন বিষয়টিকে আমি আধ্যাত্মিক বলে মনে করি। কারণ কবিতা লিখা যায় না, লেখা হয়ে যায়। হৃদয় মাঝারে যে পরম প্রভুর বাস তিঁনিই মূলত কবি, আমি সামান্য শব্দশ্রমিক মাত্র। যিনি তার ভেতরকার মহাকবির সাথে যত বেশি আত্মিক সংযোগ সৃষ্টি করতে সখ্যম হবে আমি বিশ্বাস করি কবিতায় তিনি তত বেশি মুন্সীয়ানা দেখাতে পারবেন।
![]() |
তুরাগ তীরে কবি |
দেওয়ান : সমসাময়িক কবিদের আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করেন?
ইমন ভাদ্রে : কাউকে মূল্যায়ন করবার মত ধৃষ্টতা আমি দেখাতে চাই না, কিংবা বলতে পারেন সে ক্ষমতাও আমার নাই। কবি ও কবিতার মহাসড়কে আমিও সামান্যতম পথিক ~ সুতরাং মূল্যায়নের গুরুভার সদা প্রিয় পাঠক সমাজের।
দেওয়ান : কবিতা'য় আপনি কাকে অনুসরণ করেন বা কার সান্নিধ্য আপনাকে কবিতা লেখার অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে?
ইমন ভাদ্রে : কাউকে অনুসরণ করি, কথাটি যথার্থ নয়, তবে হ্যাঁ বলতে পারেন আমার লেখনির অনুপ্রেরণা যুগিয়েছেন অনেকেই। বিশেষ করে বাংলা সাহিত্যের যাদুকর হুমায়ুন আহমেদ স্যার।
দেওয়ান : কবিতা আপনাকে কী দিয়েছে বা কবিতার জন্য কী পেয়েছেন এ জীবনে?
ইমন ভাদ্রে : কবি ও কবিতার পথধরে ইমন ভাদ্রের যা কিছু অর্জন, এ ক্ষণজন্মে তা আমার কাছে অমূল্যধন। প্রিয় পাঠকের অমূল্য সে ভালোবাসাই আমার সঞ্চয়। যা আমার কলমের মূলশক্তি।
দেওয়ান : আপনার জীবনে কোনো ব্যর্থতার গল্প রয়েছে? যা পাঠকদের মাঝে ভাগ করা যায়।
ইমন ভাদ্রে :
এমন করে আমি কবি হতে চাইনি গো প্রিয়তমা! চেয়েছি হতে তোমার নোলক, হাতের বালাখানা। আমি তো কবি হতে চাইনি গো প্রিয়তমা। জেনে শুনে কে আর আছে এমন, স্বহস্তে জহরপেয়ালা পান করতে চায়? ও বেটা কবিদের প্রতি আমার প্রচন্ড রকমের ভয়, ওরা উদাসি আত্মভোলা হয়। তৃষিতযুগল তৃপ্ত হয়েছি সমচুম্বনে হরষে গেয়ে গান, সব ভুলে কোন্ পরাণে করে গেলে এমন ব্যথা দান! যা হতে চাইনি নিয়তির খেলাঘরে আজ যে গো আমি তাই। সমাজ সমাদৃত কবি আমি, যশের কমতি নাই। অটোগ্রাফ শিকারিদের অতি সুখকর যন্ত্রণা। না, আমি এমন অনলে পুড়ে কবি তো হতে চাইনি প্রিয়তমা। নেপথ্য খুঁজে না কেউ, সাফল্য দেখেই ভাবে কোন দুঃখ নাই, আমার আমি জানি প্রতিটি পঙ্ক্তিতে কতো বিষবিরহ আছে জমা, আমি তো কবি হতে চাইনি গো প্রিয়তমা।
অবিনাশী পদ্যের উৎসর্গের লেখাটিতেই আশা করি আপনার এই প্রশ্নের উত্তর আছে।
দেওয়ান : আপনি তো জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সেকশন অফিসার৷ হিসেবে আছেন। এ গুরুদায়িত্ব পালনে নিশ্চয়ই অনেক ব্যস্ততার মধ্যে থাকতে হয়। এ অবস্থায় কবিতাকে সময় দেয়া কীভাবে হয়?
ইমন ভাদ্রে : অফিসিয়াল দায়িত্ব সততার সঙ্গে পালন করা আমার কর্তব্য। আর কবিতা লিখা আমার কাছে এবাদতসম, কবিতায় সঁপিয়া মনোপ্রায় কাটাই জিন্দেগী, পঙ্ক্তির ভাঁজে ভাঁজে করি এক অদেখা কবির বন্দিগী। তাই শত ব্যস্ততার মাঝেও কবিতা কে সময় দিতেই হয়, ঐ যে বললাম এটা আমার কাছে এবাদত।
দেওয়ান : কথা সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের সাথে আপনার সম্পর্কটা ঠিক কেমন ছিলো। আপনার দৃষ্টিভঙ্গিতে কেমন ছিলেন সবার প্রিয় হুমায়ূন আহমেদ?
ইমন ভাদ্রে : আধুনিক বাংলা সাহিত্যের সম্রাট হুমায়ূন আহমেদ স্যার বাংলা সাহিত্যের সমুদ্রসম। আমি সেই সমুদ্রের তীরে এক বালিকণা মাত্র, সুতরাং তাঁর সম্পর্কে বলবার মত ক্ষমতা বা যোগ্যতা যেটাই বলিনা কেন, কোনটাই আমার নাই। এ অক্ষমতায় আমি ক্ষমা চেয়ে যাই। স্যারের একটি দিক কেবল উল্লেখ করতে চাই ~ হুমায়ূন আহমেদ মানুষ কে চমক দিতে খুব পছন্দ করতেন। পাঠক মহলে এই আমি ইমন ভাদ্রে তখনও এক অখ্যাত। লেখনির মাধ্যমে লোকে তখনো খুব একটা চেনে না বললেই চলে। সেই সময় এমন একজন অখ্যাত লেখক কে নিজের হাতে লিখে জন্মদিনের শুভেচ্ছা পাঠিয়েছিলেন। যা আজো আমার কাছে সযত্নে রাখা আছে।
দেওয়ান : বলা হয়ে থাকে বর্তমানে পাঠকমহলে গদ্য কবিতার রাজত্ব চলছে। কথাটি আপনি কতটুকু সঠিক মনে করেন এবং আপনার অভিমত জানতে চাই।
ইমন ভাদ্রে : ◾আমি বিশ্বাস করি, কবিতার রাজ্যে কবি নিজেই রাজা। সে তার রাজ্য কীভাবে পরিচালনা করবেন সেটা তার একান্ত নিজের বিষয়। তবে রাজাকে অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে যেন তার পরিচালিত রাজ্যে প্রজার কল্যাণ নিহিত থাকে। অর্থাৎ, তার লেখায় যাতে পাঠক সমাজের জন্য শিক্ষণীয় দিক থাকে, সেটা হোক গদ্য কিংবা পদ্য রীতি অনুসরণ করে লেখা—সেটা কোনো বিষয় না। কবি কখনো কোনো ধরা-বাঁধা নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা করে না।
![]() |
কবির প্রথম কবিতার বই অবিনাশী পদ্য |
দেওয়ান : আপনার স্বরচিত কবিতার বই ‘অবিনাশী পদ্য’ ইতিমধ্যে পাঠক মহলে ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। বইটি সম্পর্কে কিছু বলবেন?
( পরবর্তীতে ‘ আগুনের ফুল ’ নামে কবির আরেকটি কবিতার বই বের হয়। এই বইটিও কবিকে আরো জনপ্রিয় করে তোলে পাঠকের মাঝে )
ইমন ভাদ্রে : ◾সুদীর্ঘ ১ যুগের অধিক সময় অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে ‘বাংলার প্রকাশন’ হতে প্রকাশিত হয় কাব্যগ্রন্থ অবিনাশী পদ্য, যা প্রকাশের পরই পাঠক মহলে ব্যাপক সাড়া ফেলে। আপনারা সম্ভবত জানেন, সে বছরই কাব্যগ্রন্থ ক্যাটাগরিতে সবচেয়ে বেশি বিক্রিত গ্রন্থের নাম ছিল অবিনাশী পদ্য। কোভিড-১৯ এর কারণে অমর ২১ গ্রন্থমেলা হয়নি বললেই চলে। পাঠক চাহিদার কারণে ২০২২ সালের গ্রন্থমেলায় বাংলার প্রকাশনের প্রকাশক অবিনাশী পদ্য আবারো গ্রন্থমেলায় নিয়ে আসেন। যেখানে প্রিয় পাঠকের আবারও আশানুরূপ সাড়া মেলে। বলতে পারেন, অবিনাশী পদ্য-ই আমার লেখনির জগতের টার্নিং পয়েন্ট। অনেকে তো এখন ইমন ভাদ্রে না বলে অবিনাশী পদ্যর কবি বলেই ডাকেন।
![]() |
ক্ষুদে পাঠিকার হাতে কবির বইদুটি |
দেওয়ান : লিটল ম্যাগাজিন না ফেসবুক—কোনটা কবিতার ছড়িয়ে পড়ার শ্রেষ্ঠ মাধ্যম, আপনার মতে? কেন?
ইমন ভাদ্রে : ◾লিটলম্যাগ হচ্ছে সাহিত্যের শেকড়। সাহিত্যে লিটলম্যাগের অবদান অসীম। একজন ঋদ্ধ লেখক তৈরিতে লিটলম্যাগের ভূমিকা অপরিসীম। বর্তমানের সাহিত্য বলতে গেলে অনেকটা ফেসবুক কেন্দ্রিক হয়ে পড়েছে, যার কল্যাণে দ্রুত তার লেখাটি পৌঁছে যাচ্ছে অনেকের কাছে। এই মাধ্যমকে আমি খারাপ দিক হিসেবে চিহ্ন করছি এমন নয়—যুগের চাহিদাকে অস্বীকার করবার উপায় নাই। তবে ফেসবুক লেখিয়েদের মান যথেষ্ট প্রশ্নবিদ্ধ।
দেওয়ান : কবিতা কি কবিকে অমর করতে পারে?
ইমন ভাদ্রে : ◾কবিতা অবশ্যই কবিকে অমরত্ব দান করে। তবে সত্যিকারের কবি হতে হবে, তবেই সম্ভব। জীবনানন্দ দাশের সেই উক্তিটি টেনে আনতে চাই প্রসঙ্গক্রমে—“সকলেই কবি নয়, কেউ কেউ কবি।” বর্তমানে কাক-কবিদের অভাব নাই। কাক-কবিরা অমরত্বের পেয়ালা তো দূরে থাক, সে অবিনাশী অমরত্বের সন্ধানই কোনোদিন পাবে না।
![]() |
পাঠকের সাথে কবি |
দেওয়ান : নবীন কবিদের প্রতি কিছু উপদেশ প্রদান করলে বাধিত হই।
ইমন ভাদ্রে : ◾সাধারণত লেখকদের আমরা দুই ভাগে ভাগ করতে পারি— ১. জনপ্রিয় লেখক ২. সিরিয়াস লেখক জনপ্রিয় লেখক কালের পরিক্রমায় একদিন অন্ধকারের অতল গহ্বরে হারাবে। সিরিয়াস লেখক ধীরে ধীরে তার সাধনা বলে অমরত্বের পথে এগিয়ে যাবে। অতএব, সস্তা জনপ্রিয়তার মোহে না দৌড়ে নিজের লেখনির সাধনায় গভীরতর মনোযোগ দেওয়া উচিত। আপনার লেখায় যদি বস্তুনিষ্ঠতা থাকে, সময় একদিন আপনাকে ঠিকই মূল্যায়ন করবে।
দেওয়ান : বর্ণমালাকে সময় দেওয়ার জন্য অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।
ইমন ভাদ্রে : ◾আপনাকেও ধন্যবাদ। বর্ণমালার জন্য অশেষ শুভকামনা রইল।
Social Plugin