মানসিবা ফাইরুজ রুসাফা'র একগুচ্ছ কবিতা


নিতান্তই দ্রোহের কবিতা


মিছিলের দাবানল পেরিয়ে,

দ্রোহের কবিতার বারুদ বুকের ভাঁজে বেঁধে,

আমি পড়ে আছি এক রক্তশিক্ত জনপদে,

যেখানে সূর্যোদয় মানেই কুঞ্জের কান্না,

আর সন্ধ্যা নামে পোড়া স্বপ্নের ধূসর ধূলিকণায়।

এই হতভাগ্য দেশে,

যেখানে প্রতিটি পথ যেন স্মৃতির শ্মশান,

যেখানে পতাকা উড়লেও রক্তের গন্ধ মোছেনি,

যেখানে শব্দরা এখনো গুলির গর্জনে থমকে দাঁড়ায়,

আমি দাঁড়িয়ে আছি এক নির্বাসিত আকাশের নিচে,

একটি স্বাধীন, তবু বন্দি ভূখণ্ডের নিঃসঙ্গ প্রহরী হয়ে।

আমার ভাষা এখনো ব্যারিকেড ডিঙিয়ে হাঁটতে শেখেনি, আমার স্বপ্ন এখনো রক্তের নদী সাঁতরে পারে পৌঁছায় না, আমার দ্রোহ এখনো এক অনির্বাণ শিখা হয়ে জ্বলতে চায়, কিন্তু এ শহর আগুনকেই খাঁচায় পুরে রাখতে চায়।

তবু আমি রয়েছি, থাকবো—

শেকড়ের গভীরে লুকিয়ে রাখা আগুনের মতো,

ঝড় এলে দাবানলে জ্বলে উঠতে,

নিঃশেষ হওয়ার জন্য নয়—

বরং আবার,

আরও একবার জন্ম নেওয়ার জন্য।


নিঃসঙ্গতার ব্যাকরণ


আমি সকল দেবতা বিসর্জন দিয়ে

আমার রক্তের কাছে ফিরে আসি,

শিরায় শিরায় জ্বলে ওঠা নির্বাক স্রোতের ভাষা পড়ি—

সে কেন নির্জন আগুনের মত নিজেকেই পুড়িয়ে কথা কয়?

এই হৃদয় কি কোনো নির্বাসিত রাজপথ,

যেখানে প্রেম এক জলের অনশন?

নাকি সে এক অভিশপ্ত দূত,

যে জন্ম জন্মান্তরে খুঁজে ফেরে কোনো শূন্য বেদনার উৎস?

আমি সকল সত্য গিলে নিই,

শুধু এই ব্যথাকে বাঁচিয়ে রাখি,

কারণ একা পথিকের শাস্ত্র একটাই—

নিজেকেই বহন করা, নিজেকেই পোড়ানো।


রক্তাক্ত রাতের নোটিশ


শত সহস্র প্রলয়ের আগে,

তোমার চোখের কুয়াশায় একবার দেখেছিলাম— মহাজাগতিক জরায়ুর গোপন আয়না,

সেখানে অ্যামিবা দৌড়াচ্ছিল অন্ধকারের হায়েনাদের সাথে, আর গোধূলির সর্ষে-রোদ ভিজে উঠছিল ঘামের কফিনে।

নক্ষত্রেরা আত্মহত্যা করেছিল সেইসব রাতগুলোতে,

অথচ পৃথিবীর জয়ধ্বনি তখনো বাজছিল—

ধ্বংসের কোরাসে, বিকেলের সানাইয়ে।

রক্তের পিপাসায় জরাগ্রস্ত হৃদয়গুলো

যখন শামুকের মতো আত্মগোপন করছিল

আর মন ছিঁড়ে শরীর ফেলে যাচ্ছিল রোজনামার পাতায়।

ধর্মের প্রাচীর, রাষ্ট্রের বিষ,

প্রজন্মের ভাসমান নৌকা—

সব কিছুরই অমোঘ বুকে ছিল একটাই চিহ্ন—

একটা ভাঙা দরজা,

যেখানে সময় এসে তালা লাগিয়ে দিয়ে গেছে আর আমরা শিখে গেছি—

রাত্রি মানে শুধু নক্ষত্রের মৃত্যুসংবাদ।