হাসিন এহ্সাস লগ্ন'র কবিতা , ‘উত্তর-শরীর, ধানগন্ধ’


 


১.

ভূমির মতোই শরীর চায়

বছরে একাধিক মৌসুম।

চাষি জানে, একবার বীজ ফেললেই

সব ফসল হয় না।

আবহাওয়ার তাপমাত্রা, বাতাসের মনোভাব,

এমনকি জলের ব্যঞ্জনাও বদলে দেয়

ফলনের ধরন।

তুমি কবে বুঝবে,

প্রতিবার আমি ধান ছিলাম না।


২.

এ ভূমি—

আদতে এক দীর্ঘ, বিশ্রামহীন নারীর দেহ।

পাখির ছায়া পড়ে গেলে যেখানে ঢেউ ওঠে,

লাঙলের প্রথম চিহ্নে

যে স্রোত নামে চুপিচুপি,

তার নাম কেউ রাখে না,

কেউ রাখে—

প্রথম ঋতু।




৩.

তুমি যেদিন কাদায় হাঁটছিলে,

ভেবেছিলে কেবল বর্ষার বিষাদ।

কিন্তু জানো,

ওই মাটি তোমার নখের নিচে ঢুকছিলো

আমার শরীর হয়ে।

জমি ও নারী,

কখনও এক হয়ে যায়

নির্দিষ্ট উচ্চতায়,

নির্দিষ্ট তাপে।


৪.

সে এসেছে উজানে, জড়ানো কাঁথা, হাতে কোদাল।

তার পায়ের নিচে

মাটি গরম হয়ে ওঠে—

এমনকি বৃষ্টির দিনেও।

আমরা তখন তাকে দেখি না,

শুধু মাটির ভিতর

নড়ে ওঠে কিছু মৌসুমী লালা।




৫.

সে হেঁটে যায় আলপথ ধরে,

পেঁয়াজক্ষেতের পাশ দিয়ে—

তার নীচু হয়ে বেঁধে-নেওয়া লুঙ্গির ফাঁকে

ঘাস ঢোকে চুপিচুপি।

তখন মেয়েরা জানলায় দাঁড়িয়ে বলে—

এ ছেলে লাঙলের মতো,

নুয়ে পড়ে, তবু কেটে যায় শরীরের ভিতর।


৬.

ছেলেটার চোয়াল শক্ত,

মাথায় মাথাল, শরীরে সূর্যের গন্ধ,

পিঠ ঘামে ভেজা—

যেন কর্ষিত জমির খোসা ছড়ে গেছে।

আমরা তাকাই, আর মাটি তাকায়—

কোনো কোনো কাম,

বহুবছর ধরে জেগে থাকে এভাবেই।





৭.

এই যে দিনাজপুর—

এখানে মাঠ মানে শরীর, আর শরীর মানে

কোনো এক চাষির ঘামে ভেজা দুপুর।

তাকে প্রেম বলে না কেউ,

তাকে কামও বলা ঠিক নয়—

শুধু বোঝা যায়,

ছেলেটার চোখে কাদা লেগে আছে,

তবু সে তাকিয়ে আছে

কারো শীতকালীন ঊরুর দিকে।


৮.

যেদিন ঝড় এসেছিলো,

সে মাথাল ছুঁড়ে ফেলে মাটির গায়ে কাত হয়েছিলো।

কেউ ভাবেনি—

তখনও ভূমি ভিজে উঠবে।

কিন্তু তৃণমূল থেকে উঠে এলো বাষ্প,

তার বুকে উঠলো

একরকম অস্থায়ী ধানগন্ধ।




৯.

সে যেন সদ্য কুমারী জমির ওপর দিয়ে

হেঁটে এসেছে—

তার পায়ের পাতায় এখনো লেগে আছে

ভোরবেলা, আর একটু আধ-ঘুম।

বৃষ্টির পর খালি পায়ে মাঠে নামবে সে।

আর আমরা, যাদের চোখে শুধু শহরের

জলীয়তা—

তাকে দেখি,

আর নিজেকেই একটু নীচু মনে হয়।


সেসব কে জানে!

জানে কেবল, কর্ষিত জমির মতো

তিনপুরুষ পর নারীর চোখও

হতে পারে উর্বর।

(এমন উর্বরতা দেখে চোখ জ্বলে যায়—

এখানে গন্ধ নেই, শুধু ঘাম আর কিছু অনাহূত রস।)


মাটি নরম ছিলো।

তুমি জানতেও পারোনি,

তোমার পায়ের নিচে আমরা অনেকেই

শরীর বিছিয়ে রেখেছিলাম—

পিঠ, ঊরু, ঘাড়, আর কিছু স্পর্শ।

যা চাষির মতোই জেনে গেছে কোথায় বীজ ফেললে

বাঁশির মতো গুঞ্জরিত হয় কুমারী জলাশয়।


পেঁয়াজক্ষেতের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময়

তুমি কেঁপে উঠেছিলে।

আমরা ভেবেছিলাম ঠাণ্ডা,

কিন্তু তোমার কাঁধে তখনও ছিলো আগুন—

যে আগুনে ঝলসে গিয়েছিলো

গত বছরের সমস্ত শস্যবর্ণ প্রেম।


সেদিন তুমি কাদায় ঠেসে বলেছিলে—

‘এইখানে চাষ হবে না।’

আহা আমার ক্ষত!

তখন থেকে ঘরের মেঝেতে কাদা ঢুকেছে

বাষ্প হয়ে, আর আমার শরীর

শুধু শুয়ে আছে চুপচাপ,

বুকে জমে থাকা তাপটুকু

তুমি আর কুড়িয়ে নাও না।

তোমার হাতে এখন শহরঘেঁষা প্রেম?

কেবল স্যানিটাইজার?


এখন আর ফলনের আশা করি না।

তুমি যাও, আর ফিরে আসো,

মাঠে পদ্মফুল না,

শুধু পড়ে থাকে ধানের খোসা।

পোকার মৃত ঘ্রাণ, আর একটা গোপন উষ্ণতা—

যেটা আমরা কেবল মাটিতে চেপে রাখি, কাম দিয়ে।


১০.

ধান শুকোচ্ছে উঠোনে,

তুমি বললে—

শরীর থেকে গন্ধ উঠছে কেমন!

আমরা চুপ করে মাটি ছুঁয়ে থাকি।

জানলার কাঠে পেঁয়াজের খোসা উড়ে যায়।

নাভির কাছে শিশির জমে।

আর কাদামাখা হাত রাখে কেউ পাঁজরে—

যেন পরীক্ষা করে দেখে নিচ্ছে,

এই জমিতে ফসল ফলবে কি না।


দিনাজপুরের ফেলে আসা গাঁ’র মাঠে,

ছেলেটা প্রতিদিন লাঙল টানে,

মাটির গভীরে ঢোকে তার চিন্তাহীন হাঁটু,

আমরা কেউ জানি না—

সে কার বীজ নিয়ে এমন কামনায়

থেমে থেমে হাঁপায়! 


এরকমই দিনাজপুরের ফেলে আসা গাঁ’য়

ঠোঁট লাগিয়ে দিয়েছিলো এক কিশোর,

সে জানতো না,

ধানের গন্ধে আমি কাম পেয়ে যাই।


বৃষ্টির পরে মাঠে দাঁড়িয়ে

পিঠ দেখালো সে—

মাটি মেখে, লাঙলের রেখা বয়ে গেছে সোজা শিরদাঁড়ায়।

আমি তাকিয়ে থাকি।

যেন ওর মেরুদণ্ড ধরে নামছে জল,

আর সেই জলে ভেসে যাচ্ছে আমার ভেতরের সমস্ত গোপন আহ্লাদ।


পেঁয়াজক্ষেতের পাশে দাঁড়িয়ে বলেছিলো,

এই গন্ধটা তোমার মুখে থাকুক সারারাত।

আমি জানতাম,

গন্ধ মুখে রাখলে সেটা আর কথা থাকে না,

শুধু রস হয়ে ঘুরতে থাকে জিভের নিচে।

ও বুঝতে পারেনি,

পোকারা কখনও পাখা মেলে না আলোয়—

ওরা কাম করে,

একটা গোপন গর্তে ঢুকে গিয়ে

বীজ রেখে যায়।


ঘরের মেঝেতে কাদা ঢুকেছে,

আমার হাঁটু কেমন মিহি হয়ে উঠেছে—

তুমি বলো,

এই কাদার ভিতর দিয়ে হাঁটলে কি আর পুরোনো শরীর ফিরে আসে?

আমি কিছু বলি না,

শুধু মনে মনে হিসেব করি,

তোমার হাত কতবার ঢুকেছে আমার পিঠে

ধান চাষের ছুঁতোয়।


শিশির পড়ে গেছে সিঁথির চুলে,

আর তুমি তখন

মাটি থেকে আমার গন্ধ শুঁকে বলছো—

এই বছর ফলন হবে না।

আমি চুপ করি।

এই চুপের নিচে ঘুরপাক খায় জলপোকারা।




আমার কোমরের ঠিক ওপাশে

ধানজমির এক টুকরো শুকনো কুসুম জেগে থাকে।


তুমি যদি জানতে—

এই শরীর শুধু কর্ষণের জন্য নয়,

নিজেই সে এক মৌসুমী ব্যর্থতা।

তুমি যদি শুধু দেখতে—

আমার দুধ না ওঠা বুকে

কীভাবে রাতভর জেগে থাকে

মাঠ ফেলে আসা ছেলেটার আঙুলের ছাপ!


কবে তুমি বুঝবে,

প্রতিবার আমি ধান ছিলাম না।




হাসিন এহ্সাস লগ্ন

জন্ম ২৯ মার্চ ২০০৬,রাজশাহী।