ট্রেনের হুঁইসেল বাজতেই অনিলের ঘুম ভাঙলো, শ্মশান নগর স্টেশনে ট্রেন এসে থেমেছে। স্টেশনের একক যাত্রী হওয়ার সুবাদে এখানটায় অনিলের সঙ্গী হয়ে অন্য কোনো যাত্রীর পা পড়েনি। স্টেশনে পা ফেলতেই অনিলের শরীরজুড়ে ভয়ানক এক তীব্র শীতল বাতাস বয়ে গেলো। বাতাসের তীব্রতা অনিলের গায়ে জড়িয়ে থাকা শালের চাদর উড়িয়ে নিতে চাইছে। সময়টা জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহ, বাতাসের সঙ্গে শীত হুহু করে বাড়ছে—হাড় কাঁপানো শীত। প্রবল হাওয়ায় একটা বিচ্ছিরি রকমের গন্ধ ভেসে আসছে, গন্ধটা এতটাই তীব্র যে অনিলের মাথা ধরে যাচ্ছে। অনিল চলে যাওয়া ট্রেনটিকে একবার দেখলো নিভু নিভু আলোয়—ট্রেনটি অন্ধকারে মিলিয়ে যাচ্ছে। অনিল গলা উঁচিয়ে চতুর্দিকে চক্ষু বুলালো, মানুষের উপস্থিতি আন্দাজ করতে। কিন্তু নজরে একটা কাকপক্ষীর দেখাও মিললো না। হঠাৎ হাত পনেরো দূরে মৃদু একটা আলোর দিকে চোখ পড়লো, অনিল আলোটার দিকে এগিয়ে গেলো।
—কি আশ্চর্য! মাত্রই তো এখানটায় আলো জ্বলছিলো, কিন্তু সেটা কোথায় উধাও হয়ে গেলো?
তৎক্ষণাৎ পাশের ঝোপ থেকে এক বৃদ্ধ কণ্ঠের কাশির আওয়াজ ভেসে আসলো।
—কে? কেহ কি আছেন এখানে? (অনিলের প্রশ্ন) কিন্তু কোনো উত্তর আসলো না। অজানা ভয়ে অনিলের গা শিউরে উঠলো।
হঠাৎ তার কাঁধে কারোর হাতের স্পর্শ অনুভব করলো—ভয়ঙ্কর ঠান্ডায় জমে যাওয়া হাত। ভীতি হৃদয়ে পিছন ঘুরতেই সে চমকে উঠলো। তার চোখের সামনে ভয়ঙ্কর চেহারার এক মানুষ—কাঁচাপাকা অগোছালো দাঁড়ি-গোঁফে মুখভর্তি। চোখের ভিতরে আগুনের শিখা জ্বলজ্বল করছে। অগোছালো দাঁড়ি-গোঁফের আড়াল হতে গুরুগম্ভীর কণ্ঠে ঠোঁট নড়ে উঠলো—
—এতো রাইতে শ্মশান নগরে ক্যান?
বৃদ্ধের ভয়ঙ্কর চেহারা দেখে অনিলের গলা শুকিয়ে আসছে। অনিল লক্ষ করলো, বৃদ্ধের হাতে একটা পাতার বিড়ি পুড়ে ছাই হচ্ছে। সে বুঝতে পারলো, দূর থেকে যে মৃদু আলো নজরে পড়েছিলো—সেটা এই বৃদ্ধের হাতে পুড়ে চলা তামাক-পাতার আগুন। বৃদ্ধের পরনে সাদা রঙের একখানা ধুতি, আর গায়ে পাতলা সুতোয় বাঁধা একখানা গামছা এঁটেছে।
—কি হইলো? কতা কও না ক্যান?
অনিল খাবি খেয়ে জবাবে বললো—
—জি, আমি অনিল। রঞ্জন ঠাকুরের বাড়িতে যাবো বলে এখানে। দুপুরের ট্রেন মিস হওয়ায় রাতের ট্রেন ধরতে হলো। কিন্তু এখানে যতক্ষণে পৌঁছালাম, গরু বা ঘোড়ার গাড়ি তো দূরের কথা—একটা পক্ষিও দেখছি না।
রঞ্জন ঠাকুরের বাড়িটাও ঠিক চিনি না। আমাকে কি সেখানটার পথটা দেখিয়ে দিবেন?
অনিলের মুখে রঞ্জন ঠাকুরের কথা শুনে বৃদ্ধ লোকটি চমকে উঠলো, অনেকটা এখনকার সময়ের বিদ্যুৎ শক খাওয়ার মতোই।
বৃদ্ধ লোকটি গলা ধরা কণ্ঠে বলে উঠলো—
—না না, আমি তারে চিনি না, আর চিনবারও চাই না। আর তোমারে একখান কতা কই—ঐখানে যাইয়া কাম নাই, বাড়িত্তে ফিইরা যাও, নইলে মুশকিল হইবো।
(শেষের কথাগুলো অনিলের কানের গোড়ায় ফিসফিসিয়ে বললো) অনিল কিছু বুঝে উঠার আগেই বৃদ্ধ লোকটি হন্তদন্ত হয়ে ঝোপের আড়াল হয়ে গেলো। বৃদ্ধ লোকটি রঞ্জন ঠাকুরের নাম শুনে এমন চমকে ওঠায় অনিল বেশ আশ্চর্য হলো।
—কে ওখানে? অনিল বাবু এয়েছেন?
অনিল পিছনে ফিরলো। একটা লন্ঠনের মৃদু আলো চোখে পড়লো। অপূর্ব এক সুন্দরী মেয়ে, নীল রঙের শাড়ি গায়ে জড়িয়ে, তার দিকেই এগিয়ে আসছে। কপালের নীল টিপে তাকে স্বর্গের অপ্সরার মতো লাগছে।
ভ্রু কুঁচকে খানিকটা বিরক্তির ভঙ্গিতে মেয়েটি অনিলকে আবারও প্রশ্ন করলো—
—অনিল বাবু, আপনের এই আওনের সময় হইলো? আপনের জন্য কহন থাইকা অপেক্কা করছি, কইতে পারেন?
—আমি সত্যিই খুব দুঃখিত। আসলে ঐ ট্রেন মিস করলাম, তাই বিলম্ব হইলো। কিন্তু আপনি কে বলুন তো? আর আমাকে চেনেন-ই বা কীভাবে? তাছাড়া আমি যে শ্মশান নগরে আসবো, সেটাতো কারোর জানার কথা না। তাহলে আপনি আমার জন্য অপেক্ষা-ই বা করছেন কী করে?
(বেশ অবাক হয়েই প্রশ্ন করলো অনিল)
খুব সম্ভবত অনিলের প্রশ্ন এড়িয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্যেই মেয়েটি যত্রতত্র উত্তরে বললো—
—আহ্, সে পরে বলবো ক্ষণে। অহন চলুন তো—দেরি হইয়া গেলে বাবাই গোস্যা করবো।
অদ্ভুতভাবে মেয়েটির উপস্থিতি, অনিলের জন্য অপেক্ষা করা—এমন অনাকাঙ্ক্ষিত বিষয়ে অনিল অত্যন্ত অবাক হচ্ছিল বটে, কিন্তু এই অপরিচিত জায়গায় কেহ তাকে চিনতে পারছে, তাকে গন্তব্যে পৌঁছাতে কেহ এগিয়ে নিতে আসছে—এটা ভাবতেই সে মনে মনে কিছুটা স্বস্তি অনুভব করছে।
তবে একটা বিষয়ে তার মনের মধ্যে বড়োসড়ো খটকা লেগেই আছে—বিষয়টি হলো, তার এখানে আসার সংবাদ কারোর তো জানার কথা না।
অনিল শহরে থাকে। শহরের নামী-দামী একটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে সবেমাত্র পড়াশোনা শেষ করেছে। সেই শহরেই কোনো এক অফিসে তার চাকরির কথা চলছে। চাকরির ইন্টারভিউ শেষে, গতকালই সন্ধ্যা নাগাদ বাসায় ফিরতেই, বাসার দারোয়ান তার হাতে একটা চিঠি দিয়ে গেলো, আর বলে গেলো বিকেলের দিকে ডাকপিওন চিঠিখানা দিয়ে গেছে। অনিল বাসায় না থাকায় সে অনিলের হয়ে চিঠিখানা গ্রহণ করেছে।
অনিল চিঠির খাম দেখে বুঝতে পারলো—চিঠিখানা তার মা লিখেছেন।
সন্ধ্যার পরে এক কাপ রঙ চা বানিয়ে, টেবিল-ল্যাম্পের আলোয় অনিল চিঠিখানায় চোখ বুলালো—
"বাবা অনিল,
মায়ের ভালোবাসা নিও। তোমার শ্মশান নগরে একটু ঘুরে আসা প্রয়োজন।
ঘাবড়িও না, বিষয়টি তেমন জটিল নয়। তবে সেখানে তোমার দূর সম্পর্কের মাসতুতো বোন থাকে।
মায়ের ইচ্ছে, তাকে পুত্রবধূ করবে।
সুতরাং চিঠিখানা পাওয়া মাত্রই তুমি শ্মশান নগর রওয়ানা হবে, এবং সেখান থেকে ফিরে এসেই তোমার মতামত সম্পর্কে চিঠি পাঠাবে।"
চিঠির শেষ প্রান্তে বড়ো বড়ো অক্ষরে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে—আদেশক্রমে, তোমার মা।
মায়ের সম্মানার্থেই অনিল এখানে এসেছে। কিন্তু সে যে আজই শ্মশান নগরে আসবে—এ খবর কাউকেই জানায়নি।
তাহলে এই স্বর্গীয় অপ্সরার মতো সুন্দরী মেয়ে আসলে কে? আর তার শ্মশান নগরে আসার খবর যেহেতু কেহ-ই জানে না, তাহলে তার জন্য এই মেয়ের অপেক্ষার কারণ কী? তার ওপর এই কনকনে শীতের মধ্যে শরীরে শুধুমাত্র একখানা শাড়ি জড়িয়ে আছে!
—কি জানি, হয়তোবা গরম কাপড়ে শাড়ির সৌন্দর্য ঢাকা পড়ে যায় ভেবে মেয়েরা তাদের সৌন্দর্য প্রকাশে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। কিন্তু ঐ বৃদ্ধ লোক? সেও তো গায়ে শুধুমাত্র একখানা গামছা এঁটেই ঘুরে বেড়াচ্ছে!
কি সব অদ্ভুতরে কান্ড ঘটছে তার সঙ্গে! তাহলে কি সে কোনো অশরীরীর শহরে এসে পড়েছে?
(অনিল নিজে নিজে, নিজেকেই প্রশ্ন করে যাচ্ছে, আবার নিজেই উত্তর খোঁজার চেষ্টা করছে)
—না না, তা কী করে হয়? এই বিজ্ঞানের যুগে সে একজন বিদ্যাশিক্ষিত মানুষ হয়ে এগুলো কি ভাবছে?
তবুও কেন যেন কোনো এক অজানা ভয়ে অনিলের গা শিউরে উঠছে। মনে হচ্ছে শরীরে ঘাম হচ্ছে, হৃদয়ের মধ্যে খানিকটা ভীতি উদয় হয়েছে।
—বাবু, বিড়ি টানবেন? পাতার বিড়ি? (হঠাৎ মেয়েটির প্রশ্ন)
—কি আশ্চর্য, আপনার সঙ্গে বিড়িও আছে?
—কেন, মাইয়া-মাইনষের বিড়ি খাওন কি মানা আছে?
মেয়েটির প্রশ্নে অনিল হতবাক হয়ে গেলো। সে জানতো, আজকাল শহুরে মেয়েদের মাঝে মাঝে ধূমপান করতে দেখা যায়। কিন্তু সেটা যে শহর পেরিয়ে গ্রামগঞ্জেও পৌঁছে গেছে—সেটা তার ভাবনার বাইরে ছিলো এতদিন।
মেয়েটি অনিলের ধারণা ভুল প্রমাণিত করে বলে উঠলো—
—কি চমকাইলেন বুঝি? হিহিহি... দুষ্টামি করলুম। চমকাইয়েন না বাবু, আমি বিড়ি খাই না। তবে একখান কতা—শুধু মাইয়া-মাইনষের লাইগা না, বিড়ি কারুর লাইগাই ভালা না। এতে অসুখ করে।
কিন্তু আমার মনে হইলো, আপনে মনে মনে ডরাইতাছেন। তাই বিড়ি টাননের কথা কইলাম। মুরুব্বীরা কয়—বিড়ির আগুনে নাকি জ্বীন-ভূতেরা ডর পায়। আপনে বিড়ি টানলে পাশের দোকানিকে ডাইকা তুলুম, তাই কইলাম।
—না না, তার দরকার নেই। আমি বিড়ি পছন্দ করি না। আচ্ছা, আপনি কে বলুন তো? আপনার পরিচয় না জেনে এভাবে আপনার সঙ্গে পথ চলাটা ঠিক মনে হচ্ছে না।
—জি, আমার নাম নীলাদ্রি। সম্পর্কে আপনের মাসতুতো বোইন লাগি। অহন আর কিছুই কইবার পারুম না—বাকি কথন বাড়িত্তে গেলেই হইবো।
মেয়েটির তথ্য মতে এই মেয়ের সঙ্গেই অনিলের বিবাহের বন্দোবস্ত করেছে তার মা।
যদি তাই হয়, তাহলে অনিলের দ্বিমত পোষণের কোনো কারণ নেই। কারণ মেয়েটি যথেষ্ট সুন্দরী। নীলাদ্রির সৌন্দর্য আর চঞ্চলতায় অনিলের মনে ধরেছে বেশ। সে মনে মনে ঠিক করে নিলো—কাল ভোরে ঢাকায় ফিরেই তার সম্মতি জানিয়ে মায়ের কাছে চিঠি লিখবে।
বড়ো রাস্তা ছেড়ে নদীর পাড় ঘেঁষে সরু পথ নেমে গেছে, বুনো জংলা পায়ে ঠেলে অনিল নীলাদ্রির পিছন পিছন হাঁটছে।
হটাৎ বাতাসের সঙ্গে ভেসে আসা একটা ভয়ঙ্কর কুকুরের ডাক অনিলের কানে এসে লাগলো।
অদ্ভুত বিষয় হলো ডাকটা কোন সাধারণ কুকুরের না, অনেকটা নেকড়ের ডাকের মতো।
কিন্তু বাংলার বন-জঙ্গলে নেকড়ে, এটাতো রীতিমতো আকাশকুসুম ভাবনা।
-আচ্ছা নীলাদ্রি ঐ ভয়ঙ্কর কুকুরের ডাকটা শুনতে পেলেন? (অনিল প্রশ্ন করলো)
নীলাদ্রির কোন উত্তর নেই, অনিল চমকে উঠলো। সে লক্ষ করলো, তাকে পথ চিনিয়ে নিয়ে আসা মেয়েটি এখন আর, তার সামনে নেই।
লন্ঠনের আলোটাও উধাও হয়ে গেছে, অনিলের প্রচন্ডরকমের ভয় হলো, সে নীলাদ্রিকে ডাকছে কিন্তু নীলাদ্রির কোন সাড়াশব্দ নেই।
বেশ ক-বার, ডাকার পরে সামনে থেকে নীলাদ্রির কন্ঠে- সাড়া আসলো।
-এইতো অনিল বাবু, এদিকটায় আমি এখানটায় আসুন। নীলাদ্রির কন্ঠের সঙ্গে, ভয়ঙ্কর একটা সুরে অট্টহাসি ভেসে আসলো।
হটাৎ-ই' চতুর্দিকে বাতাস বয়তে শুরু করেছে, হিমশীতল হাওয়া।
গাছের ডাল এসে, অনিলের গায়ের উপর পড়ছে। ভয়ে অনিলের আত্মা কেঁপে উঠলো, সে গলা ছেড়ে স্বজোরে চিৎকার করে উঠলো।
কি আশ্চর্যের বিষয় চোখের পলকেই, সব কিছু শান্ত হয়ে গেলো। কোন বাতাস নেই, সেই ভয়ঙ্কর হাসিও নেই। অনিল এবার আরো বেশি ঘাবড়ে গেলো, নিশ্চয়ই তার সঙ্গে কোন খারাপ কিছু ঘটতে যাচ্ছে- যত দ্রুত সম্ভব এখান থেকে তার বের হতে হবে। নয়তো তার জন্য ঘোর বিপদ অপেক্ষা করছে, বিপদের আচ টের পেয়ে অনিলের গলা শুকিয়ে গেলো। সে ব্যাগ থেকে পানির বোতল বের করে দু-ঢোক পানি পান করলো।
পানির বোতল ব্যাগে রাখতেই, অনিল লক্ষ করলো তার সামনে জীর্নসীর্ন একটা কুড়ে ঘর, দরজার ফাঁক দিয়ে লন্ঠনের আলো দেখা যাচ্ছে। অনিল এদিক-ওদিক কিছু না ভেবেই, সেদিকে ছুটে গেলো- হয়তো-বা কোন সহযোগিতা পাওয়া যাবে সেই আশায়।
-কেহ আছেন? ঘরে কি কেহ আছেন? প্লিজ আমাকে কেহ সাহায্য করুন।
ভিতর থেকে কোন সাড়াশব্দ এলো না, অনিল দরজাটা ধাক্কা দিলো। দরজা খুলতেই অনিল চমকে উঠলো, কুঁড়ে ঘরের ভিতর থেকে এক বৃদ্ধ বেরিয়ে আসলো।
-কি চাই? বৃদ্ধের মুখভর্তি একগাদা কাঁচাপাকা দাঁড়ি গোঁফ আর সেই পূর্বপরিচিত গম্ভীর কণ্ঠ শুনে অনিলের বুঝতে বাকি রইলো না, সে কোন অশরীরীর ডেরায় এসে ফেঁসে গেছে। অনিলের গায়ের লোম গুলো অদ্ভুতভাবে দাঁড়িয়ে গেছে, তার হাত পা কাঁপছে। অনিল মনে মনে ভাবছে সে কোন কুক্ষণে যে শ্মশান নগরে আসতে গেলো, শুধুমাত্র মায়ের সম্মানার্থেই এখানে.....
মায়ের কথা ভাবতেই অনিল চমকে উঠলো, সে কি করে মায়ের চিঠি পাবে? তার মা-তো আজ থেকে প্রায় ৫বছর আগেই মারা গেছে। তার মানে সে সত্যি সত্যিই, অশরীরী আত্মার কবলে পড়েছে- তৃষ্ণায় অনিলের গলা বারবার শুকিয়ে আসছে।
-কি হলো কি চাই? (বৃদ্ধ ভয়ঙ্কর গম্ভীর কণ্ঠে প্রশ্ন করলো) বৃদ্ধের প্রশ্ন শেষ না হতেই, কুঁড়ে ঘরের ভিতর থেকে! একটা মায়াবী কন্ঠ ভেসে আসলো।
-বাবাই ওরে ভিতরে আয়তে দাও।
এই কন্ঠ অনিল আগেও কোথায় যেন শুনেছে, হ্যা মনে পড়েছে স্টেশনের নীলাদ্রি, এটা তার-ই' কন্ঠ।
কিন্তু এখন তার কন্ঠ এমন ভয়ঙ্কর শোনাচ্ছে কেন? (অনেকটা হরর মুভির নিশির ডাকের মতো।)
অনিলের বুঝতে বাকি রইলো না, সে ফেঁসে গেছে, খুব বাজে ভাবে ফেঁসে গেছে। যতটা দ্রুত সম্ভব, তাকে এই শ্মশান নগর ছাড়তে হবে। তা-না হলে সে মারা পড়বে, অনিল নিজের জীবন বাঁচাতে, চোখ-মুখ বুঝে প্রাণপনে ছুট দিলো।
কিন্তু তার পথ যেন ফুরাচ্ছে না, ঘুরেফিরে বোধহয় সে এক যায়গা দিয়েই ছুটে বেড়াচ্ছে। গাছের কাটায় অনিলের পা কেটে, টপটপ করে রক্ত ঝরছে।
হটাৎ অনিল অনুভব করলো, সে হাওয়ায় ভাসছে। তার গলা চেপে ধরে, কেহ যেন তাকে উপরে উঠিয়ে নিচ্ছে। ভয়ে অনিলের চোখের পাতা লেগে আছে, চোখ খুলতেই চোখের সামনে ভেসে উঠলো ভয়ঙ্কর আকৃতির একটা বিচ্ছিরি চেহারার মেয়ে। মেয়েটির চোখে আগুন জ্বলছে, মাথার জটচুল গুলো বাতাসে এবড়োথেবড়ো হয়ে উড়ছে। মুখ থেকে বুক অবধি জিহ্বা বেরিয়ে আছে, অনিল বুঝতে পারলো এই ভয়ঙ্কর চেহারাটি আর কারোর নয়- এটি স্টেশনে দেখা সেই অপ্সরার মতো সুন্দরী নীলাদ্রির চেহারা, কি ভয়ঙ্কর বিষয় কে ভাবতে পারে এই বিদঘুটে বিচ্ছিরি চেহারার মেয়েটিকেই কিছুক্ষণ আগেও অনিলের কাছে স্বর্গীয় অপ্সরার মতো সুন্দর লেগেছিলো।
অনিল চিৎকার করার চেষ্টা করছে, কিন্তু তার কন্ঠস্বরের আওয়াজ নিস্তেজ হয়ে গেছে। অনিল শ্বাস নিতে পারছে না, চোখ মেলে তাকানোর শক্তিও হারিয়ে ফেলেছে। সে মনে মনে দেবদেবীর নাম নিলো, জিহ্বা নাড়িয়ে ঈশ্বরের নাম ডাকার শক্তি নেই তার। মনে মনে ধর্মীয় মন্ত্র পাঠ করে চলছে, তবুও যেন এই রাক্ষসী রাজ্য থেকে বাঁচার উপায় নেই। স্টেশনের সেই বিচ্ছিরে গন্ধটা আবারও তার নাকে লাগছে, গন্ধটা আরো তীব্র হচ্ছে মনে হচ্ছে বাঁশি-পচা লাশের গন্ধ অনিলের দম বন্ধ আসছে, মাথা ঘুরছে, সে শ্বাস নিতে পারছে না- এই বোধহয় দমটা বেরুবে।
অনিলের দেহ নিস্তেজ হয়ে পড়েছে এখন তার কান অবধি নীলাদ্রির সেই ভয়ঙ্কর অট্টহাসি পৌঁছাতে পারছে না- অনিলের দেহ মাটিতে লুটিয়ে পড়লো।
যতক্ষণে অনিলের হুঁশ ফিরলো, অনিল দেখলো সে একটা বাঁশের মাচায় স্যাতস্যাতে কাঁথার উপরে শুয়ে আছে। তার মাথার নিচে শিমুল তুলার ময়লাটে একটা তৈলচিটে বালিশ দেওয়া হয়েছে, ময়লাটে হলেও অনিল বেশ আরাম উপলব্ধি পাচ্ছে। অনিল শোয়া থেকে উঠে বসতে গেলে, অনুভব করতে পারলো তার মাথায় এখনও কিঞ্চিত অস্বস্তি হচ্ছে। মাথাটা এখনও ঝিম মেরে আছে, শোয়া থেকে উঠে বসার পরিপূর্ণ শক্তি তার শরীর যোগান দিতে ব্যর্থ। তাকে দেখতে জড়ো হওয়া লোকের ভিড় হতে, দুজন লোক অনিলকে ধরে বসিয়ে দিলো- অনিল এতক্ষণে লক্ষ করলো তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে রয়েছে অসংখ্য মানুষ, অসুস্থ অনিলকে দেখতে আসা উৎসুক জনতার ভিড় কম নয়, গোটা বিশেক লোক তার দিকে তাকিয়ে আছে অবাক দৃষ্টিতে, তারই মধ্য থেকে সিকসিকে লম্বা এক চশমাওয়ালা ভদ্রলোক উৎসুক জনতার ভিড় ঠেলে, অনিলের সামনে এসে জিগ্যেস করলো :
-তুমি রঞ্জন ঠাকুরের ঐ ভুতের ডেরায় ক্যামনে গেলা? ঐহানে কি কোন সুস্থ মাইনষে যায়? ঐ ভুতের ডেরায় গেলেই, তার মরণ হইবোই হইবো। এই এলাকার কোন মাইনষেই, মরণের ঢরে ঐ ভুতের ডেরায় যায় না।
এই যে শ্মশান নগরের নাম হুনতাছো, এই নামখানা হওনের কারণ ঐ রঞ্জন ঠাকুরের ভুতের ডেরা।
সে অনকে কাল আগের কথা, আমার দাদার কাছ থাইকা হুনছি। রঞ্জন ঠাকুরের একখানা সুন্দর কণ্যা আছিলো, দুই-চাইর এলাকায় ওমন সুন্দরী মাইয়া নাকি খুঁইজা পাওন যাইতো না।
সুন্দরী কণ্যার বিয়া ঠিক হইলো, পোলাও নাকি সুন্দর আছিলো- বড়োলোকি ঘর, গঞ্জের ব্যবসা। তয় মুশকিল হইলো গিয়া পনের পয়সা লইয়া, পোলার বাপে পণ চাইয়া বসে বহুৎ পয়সাকড়ি।
পণের পয়সা না দিতে পারায় মাইয়াডার বিয়া ভাইঙ্গা যায়, বিয়া ভাইঙ্গা মাইয়ার কি আর বিয়া হইবো? হের লাইগা দুঃখ কষ্টে, রঞ্জন ঠাকুর গলায় ফাঁস লয়। বাপের শোক সয়তে না পাইরা, মাইয়াডাও শরীরে আগুন দিয়া মরে।
ঐ ঘটনার পর থাইকা রঞ্জন ঠাকুরের বাড়ির আশেপাশে কেহ গেলেই তারে রঞ্জন ঠাকুরের আর তার মাইয়া নীলাদ্রির আত্মা মাইরা ফালায়, কারোর গলা টিইপা মারে কারোর গায়ে আবার আগুন জ্বলে।
তয় একখান কতা যতগুলান মানুষ মরছে এহন পর্যন্ত, তারা সকলেই বিয়ের পাত্র নয়তো বরের বাপে। এতো পরিমাণ লাশ পড়তে লাগলো যে, এই এলাকার নাম হইয়া গেলো "শ্মশান নগর" এ গায়ের মানুষ ভুলেও ও মুখো হয় না, তুমি ক্যান গেলা?
অনিল সব কিছু শুনে বাকশুন্য হয়ে পড়ে, তার যেন কোন প্রশ্নের উত্তর জানা নেই- ঠোঁট নাড়িয়ে শব্দ বের করার ক্ষমতাও নেই। ঘন্টা দেড়েক বাদে শরীরে খানিকটা সুস্থতা অনুভব করায় সে সকালের ট্রেনেই ঢাকার উদ্দেশ্য রওনা হলো।
ঢাকায় ফিরেই বাবার কাছে একটা চিঠি লিখলো :
প্রিয়ো বাবা আমায় ক্ষমা করো, তোমার পছন্দের মেয়েকে আমি বিয়ে করতে পারবো না, মেয়ে অসুন্দরী বিষয়টি কিন্তু তেমন না। সমস্যার কথা হলো, যৌতুকের টাকায় আমি বিয়ে করতে পারবো না। যৌতুক বর্জন করে, যে কোন মেয়ের সঙ্গেই বিয়ের কথা বলবে- আমি সম্মতি জানাবো।
আজ অনিলের চাকরির প্রথম দিন, সে একটা পত্রিকা অফিসে সম্পাদক হিসেবে কাজ পেয়েছে। তার পত্রিকার পাতায় শুরুতেই ছাপা হলো "যৌতুককে না বলুন" শিরোনামে একটা কলাম।
Social Plugin